সোনার বাংলা: পৃথিবীর ওজন কত? কৌতূহলী প্রশ্ন বটে। যাঁরা একটু বিজ্ঞান সচেতন, তাঁরা জানেন, প্রশ্নটা বলে আসলে ওজন বোঝানো হচ্ছে না। জানতে চাওয়া হচ্ছে ভর। সঠিক প্রশ্নটা তাই হবে, পৃথিবীর ভর কত? গুগল করলেই পাওয়া যাবে উত্তর। ৫.৯৭২×১০২৪ কেজি।
এখন আসল প্রশ্নটা। কৌতূহলী হলে নিশ্চয়ই আপনার মাথায় এসেছে। পৃথিবীর এই ভর (বা চলতি ভাষায় ‘ওজন’) মাপা হলো কীভাবে? মজা করে কেউ কেউ বলতেই পারেন, একটা বিশাল পাল্লায় পৃথিবীটাকে বসিয়ে মেপে ফেললেই তো হয়, নাকি! তা, অমন দুষ্টবুদ্ধি আপনার আগেও আরও অনেকের মাথায়ই এসেছে। এই যেমন ১৯ শতকের একটা মজার ছবির কথাই ধরুন। সিনাগগ নামের একটি বিখ্যাত বইতে এর বিষয়বস্তুর উল্লেখ আছে। বইটার লেখক গ্রিক সভ্যতার পড়ন্ত বেলার অন্যতম সেরা গণিতজ্ঞ প্যাপাস অব আলেকজান্দ্রিয়া। তিনি আর্কিমিডিসের একটা উক্তি তুলে ধরেছেন, সে অনুযায়ী ১৯ শতকের এই দুষ্ট (কিংবা হয়তো সিরিয়াসই, কে জানে!) যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটা সি-স রাইডের একপাশে বসে আছেন আর্কিমিডিস, অন্য পাশে পৃথিবীটা রাখা। (সি-স রাইড মানে, পার্কে ঢেঁকির মতো যে রাইড থাকে। দুপাশে দুজন বসতে পারেন। যাঁর ভর বেশি, তার পাশটা নেমে যায়। হালকা ভরের মানুষটি উঠে যান ওপরের দিকে।)
পৃথিবীর দিকটা নেমে গেছে নিচে ভরের জন্য। সঙ্গে আর্কিমিডিসের উক্তি, ‘আমাকে যথেষ্ট বড় একটা লিভার (এক্ষেত্রে তক্তা) দাও, একটা ফালক্রাম দাও ওটাকে বসানোর জন্য, আমি পৃথিবীটাকে তার কক্ষপথ থেকে সরিয়ে দেব।’
মানুষটা আর্কিমিডিস বলে কথা। এই বিজ্ঞানী সত্যি সত্যিই পৃথিবীটাকে আড় দিয়ে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে দেখতেই পারতেন। বিজ্ঞানীদের মন-মেজাজের তো কোনো ঠিক নেই!
বলা বাহুল্য, এভাবে পৃথিবীর ওজন মাপা যায়নি। এই চেষ্টাটা প্রথম করেছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিস। ১৭৯৮ সালে তিনি পৃথিবীর ওজন মাপার এই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন।
বিজ্ঞানীদের কথা ভাবলেই আপনার মাথায় যে ছবি ফুটে ওঠে, গোমড়া মুখ, অসামাজিক-তার মধ্যে ক্যাভেন্ডিসকে সহজেই বসানো যায়। যদিও বর্তমানে বিজ্ঞানীরা ওরকম মুখ গোমড়া করে থাকেন না। আজকের বিজ্ঞানীরা ইউটিউবে ভিডিও বানান, বই লেখেন, রসিকতাও করেন। তবে ক্যাভেন্ডিস যেহেতু সেই চিরায়ত ‘বিজ্ঞানী’ ধারণার মূর্ত প্রতীক, কথিত আছে, তাঁর কাপড়-চোপড়ের ধাঁচ ছিল তাঁর কালের চেয়ে ৫০ বছর পুরোনো। অসামাজিক ধরনের ছিলেন, নারীদের ভয় পেতেন। পড়শিরা যেন না দেখে, সেজন্য হাঁটতে বের হতেন রাতের বেলা। ধনী মানুষ ছিলেন। নিজের ভৃত্যদের সঙ্গে যেন দেখা না হয়, সে জন্য তাঁর আলাদা সিঁড়িও ছিল!
সে কালের বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর মতোই ক্যাভেন্ডিস ছিলেন ধনী। নিজ খরচেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারতেন। নিজের বাসাকেই বানিয়ে নিয়েছিলেন গবেষণাগার।
তাঁর প্রায় ১০০ বছর আগে স্যার আইজ্যাক নিউটন মহাকর্ষ সূত্র প্রকাশ করে গেছেন। সেই সূত্রটা আমাদের পরিচিত। সূত্রটায় যে দুটো বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষ বল মাপতে চাওয়া হয়, তাদের ভর ও মহাকর্ষীয় ধ্রুবক গুণ করতে হয়। তারপর বস্তু দুটোর দূরত্বের বর্গ দিয়ে ভাগ করে দিলেই হলো। কেল্লাফতে!
ঘটনা হলো, নিউটন কিন্তু নিজে এই মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান বের করার কোনো চেষ্টা করেননি। পৃথিবীর ভরও মাপতে চাননি। ১৭ শতকে এসে বিজ্ঞানীদের এই কৌতূহল মাথাচাড়া দেয়। তখন নানা জন নানাভাবে এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। কেউ কেউ প্রস্তাব করেন, ভর মাপার জন্য ঘনত্ব মাপা যেতে পারে। ১৭৭২ সালে রয়্যাল সোসাইটি রীতিমতো ‘কমিটি অব অ্যাট্রাকশন’ বা আকর্ষণ পরিষদ গঠন করে। তাদের কাজ, পৃথিবীর আকর্ষণ ও ঘনত্ব পরিমাপ করা। এ সময় একটা প্রস্তাব আসে, খুব সুষম গঠনের একটা পাহাড়ের ওপর পেন্ডুলাম দুলিয়ে ওটার ওপর মাধ্যাকর্ষণের টান পরিমাপ করা যেতে পারে। যদিও এই প্রভাব হবে খুব সামান্য। সেই পরিষদ কিন্তু তাতে দমে যায়নি। ক্যাভেন্ডিসও সেই দলে ছিলেন। তাঁরা স্কটল্যান্ডের বিশাল এক পর্বতের ওপর এরকম পেন্ডুলাম দুলিয়ে হিসাব করে দেখলেন, পৃথিবীর ঘনত্ব পানির সাড়ে ৪ গুণ। (এটা সঠিক হিসাব নয়।) ক্যাভেন্ডিস দেখলেন, এই পরীক্ষায় এমন কিছু অনুমানের ওপর নির্ভর করা হয়েছে, যেগুলোর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। কাজেই, তিনি বুঝলেন, এভাবে হবে না।
বয়স বাড়ছে। ক্যাভেন্ডিস ভাবছেন কী করা যায়। মেঘে মেঘে হোক কিংবা সমুদ্রে পানি গড়িয়ে হোক, ক্যাভেন্ডিসের বয়স যখন ৬৭, তখন তাঁর মাথায় চমৎকার এক আইডিয়া এল। বিজ্ঞানের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আইডিয়া।
১৭৯৭ সালের কথা। ক্যাভেন্ডিস তাঁর আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করলেন। এক বন্ধু-ভূতত্ত্ববিদ রেভারেন্ড (পাদ্রী') জন মিচেল-তাঁকে একটা টরসন ব্যালেন্স দিয়েছিলেন। জিনিসটা তাঁর কাজের জন্য যথেষ্ট ছিল না। ক্যাভেন্ডিস সেটাকে একটু ঠিকঠাক করে নিলেন প্রথমে।
এখন কথা হলো, টরসন ব্যালেন্স জিনিসটা কী? এই যন্ত্রে ৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটা কাঠের দণ্ড ছিল। আড়াআড়িভাবে দণ্ডটাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা তার দিয়ে। এই দণ্ডের দুই প্রান্তে যুক্ত ছিল ২ ইঞ্চি ব্যাসের ০.৭৩ কেজি ভরের দুটো সীসার বল। তারপর তিনি ছবির মতো করে ছোট বল দুটোর সঙ্গে দুটো বড় সীসার বল বিপরীতভাবে দুপাশে আটকে দিলেন। এই বল দুটোর ব্যাস ১২ ইঞ্চি, ভর ১৫৮ কেজির মতো। এখানে আইডিয়াটা হলো, বল দুটোর পারস্পরিক আকর্ষণের কারণে সুতোটা সামান্য মোচড় খাবে। এরকম দুটো সাধারণ বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষ বল আসলে অতি অতি সামান্য। কিন্তু বল দুটোর মধ্যকার আকর্ষণ বল পরিমাপ করা সম্ভব।
ক্যাভেন্ডিস দিন-রাত এই পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করে আকর্ষণ বল মাপলেন। বস্তু দুটোর ভর তিনি জানেন, জানেন এদের দূরত্ব। এর মাধ্যমে সহজেই হিসাব করে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, G-এর মান বের করে ফেলা সম্ভব।
ব্যস! এখান থেকে এবারে শুধু আরেকটি সূত্রে G-এর মান বসানোর অপেক্ষা। সূত্রটি হয়তো অনেকেরই পরিচিত। এই সূত্রে বসিয়ে পৃথিবীর ভর বা ঘনত্ব হিসাব করেছেন মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী। সূত্রটির একদম খুঁটিনাটি ব্যাখ্যায় আমরা যাব না। তবে আগ্রহীরা সূত্রটি দেখে নিতে পারেন
এখানে G মহাকর্ষীয় ধ্রুবক, Rearth পৃথিবীর ব্যাস, g মহাকর্ষীয় ত্বরণ বা আকর্ষণ, ρearth পৃথিবীর ঘনত্ব। (কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করতেই পারেন, পৃথিবীর ব্যাস কীভাবে মাপা হলো? সে জন্য এই লেখাটি পড়তে পারেন।'
Publisher & Editor: Nirob Hasan Nirjhor
Editor Phone: +8809638077499, News Room: +8801711413059, +8801812910910
E-mail: news@sonarbangla24.com, Office Address: Purbali Market, Shiroil, Rajshahi, Bangladesh
Facebook Page: https://www.facebook.com/SonarBangla24
Website: https://www.sonarbangla24.com